শ্রুতি নাটিকা – সম্বোর্ধনা
– অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ
ঘরের পাশে চেয়ারে বসে পেন খাতা নিয়ে বিষ্টু মাস্টার–
বিষ্টু স্যার—(মাথায় মুখে হাত দিয়ে) বলি শুনছ, আমার চশমাটা দেখেছ? কোথায় যে রেখেছি? খুঁজে দাও তো গিন্নি। খুব দরকার।
গিন্নী —— চশমা? ভালো করে খুঁজে দেখো। তোমার কাছেই আছে। কি যে ভুলো মন হয়েছে তোমার?
বিষ্টুস্যার– আমার কাছে? কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো?
বিষ্টু স্যার—-পকেটে কী শুনি? পাঞ্জাবির পকেটে রেখে আর চারিদিকে চশমা খুঁজছো।
স্যার — ও তাই তো। খেয়াল করিনি গো গিন্নী। মন দিয়ে ভাবছি তো। কত কথা। কত স্মৃতি। তারপর লেখাটি শেষ করব।
গিন্নী —বলি কী এত লিখছ? যেদিন থেকে স্কুল থেকে অবসর নিলে, সেদিন থেকে লিখেই যাচ্ছো।
স্যার– তুমি বুঝবে না গো গিন্নী। এসব দরদের কথা, আবেগের কথা কিচ্ছু বুঝবে না। বড্ড কষ্ট হয় গো। বাড়িতে একা একা থাকতে, খুব মন কেমন করে।
গিন্নী— তাই বুঝি? বলি কাকে নিয়ে এত ভাবছ? বুড়ো বয়সে আবার প্রেমে পড়লে নাকি?
বিষ্টু স্যার— কী যে বলো গিন্নী। এসব হেঁয়ালি করার এখন সময় আছে? যখন তখন ফাজলামি ভালো লাগে না।
গিন্নী — তা,বেশ। আর বলব না।
এবার বলো তো কী এত লিখছ?
বিষ্টু স্যার— একটা বক্তৃতা। একটা বক্তব্য। বুঝলে গিন্নী বিদায়ী সম্ভাষণ লিখছি।
দীর্ঘ ৩০ বছরের স্কুল জীবনের ভালো -মন্দ, সুখ দুঃখ,হাসি কান্না সব লিখছি এই খাতায়।
গিন্নী— বক্তৃতা?
স্যার—স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মনে পড়ে যাচ্ছে প্রথম দিনের সব কথা।
.গিন্নী — — তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বসে বসে যত এসব মনে করবে, শরীর খারাপ হবে। আর এত বড় লেখা কেউ এখন শুনবে বলে মনে হয়?
স্যার– কেন শুনবে না ? আমাদের জন্যই তো অনুষ্ঠানটা হচ্ছে। কত ভালোবাসে সবাই।
আর আমার বক্তব্য শুনবে না। তা হয়?
গিন্নী—- সবার জীবনের কাহিনিই বড়ো করুণ । শুধু কি তুমি একা? দীর্ঘ বছরের অভিজ্ঞতা সবাই যদি লিখতে বসো, একটা ইতিহাস হয়ে যাবে।
স্যার– (আপন মনে) জানো গিন্নী, সময়টা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। স্কুলটা নিয়ে কত কিছু ভেবে ছিলাম। দুবছর লকডাউনে কিছুই করতে পারি নি শেষ সময়টা। স্কুলের ঘন্টা ধ্বনি এখনো কানে বাজে। ১১ টা বাজলেই মন ছুটে যায় স্কুলে।
মেয়ে— —–
তুমি তো যেতেই পারো স্কুলে। সুজয় কাকু তো বলেছে, একদিন করে স্কুলে যেতে। এখন তো উনিই ইনচার্জ।
স্যার– তা বলেছে বটে। তবু কোথাও যেন একটা অধিকার হারিয়ে ফেলেছি। দাবী আর করতে পারি না।
মেয়ে—
ও বাবা, তুমি এখনো এসব নিয়ে ভাবছ? এই তো সেদিন আমাদের বড়দি অবসর নিলেন। আমরাও প্রণাম করলাম। বড়দিকে জড়িয়ে ধরে কত মন খারাপ করলাম। বড়দি যত কাঁদে,আমরাও তত কেঁদে ফেলি। কী করব বলো। সময় হলে চলে যেতেই হবে। নতুনদের জন্য পদ ছেড়ে দিতে হবে বাবা। তুমি আর মন খারাপ করো না। শরীর খারাপ করবে।
স্যার— দূর, বোকা। মন খারাপ করবে কেন? আমি বেশ ভালো আছি। শুধু মাঝে মাঝে —
জানিস তো মা, যেদিন চলে এলাম স্কুল থেকে। ক্লাস ওয়ানের রিতিশা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। আর মুখে বলছে, তুমি যাবে না স্যার। তুমি চলে গেলে কে গল্প শোনাবে? ভুতের গল্প, বাঘের গল্প, আর মজার মজার ছড়া।
সব ছেলে গুলো গেট আটকে দাঁড়িয়ে ছিল। কী করে ভুলি রে মা? চোখের সামনে ভেসে উঠছে সব।
মেয়ে— জানি বাবা। সব বুঝতে পারছি। এত কষ্ট পেলে তোমার প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করে ঘুমাও।
গিন্নী — অনেক হয়েছে। এবার লেখা বন্ধ করো। বেশি রাত না করে ঘুমাও।
স্যার— তোমরা যাও তো বাপু। বিরক্ত কর না এখন । আমার হাতে অনেক সময়। লেখাটি শেষ করে তবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারব।
আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি গিন্নী।
সামনেই ৫ই সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। ওই দিনই আমাদের বিদায় সম্বোর্ধন।
মন দিয়ে লিখতে দাও। এখন যাও তো।
দ্বিতীয় দৃশ্য —-
অনুষ্ঠান শুরু- হচ্ছে।
অনুষ্ঠান পরিচালক -/সঞ্চালক
আজ ৫ ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। সেই উপলক্ষে একটি সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
উপস্থিত বিদায়ী শিক্ষক শিক্ষিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হচ্ছে।
স্যার– (বারবার কাগজটা বের করে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। ভালো করে বলতে হবে।) কখন যে আমাকে ডাকবে? তার আগে আরও একবার পড়ে ফেলি।
সঞ্চালক——
প্রথমেই একটা সমবেত উদ্বোধন সংগীত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করছি।
পরবর্তী সংগীত শিল্পী প্রস্তুত থাকুন।
শিল্পী — রমা চৌধুরী।
তারপর আছে সমবেত নৃত্য। আপনারা শুনতে থাকুন আমাদের অনুষ্ঠান।
স্যার—- এখন বাজে ১টা। নিশ্চয় একজনের নাচের পরই আমাকে ডাকা হবে। এত ঘাবড়ে যাচ্ছি কেন? না না আমাকে ঘাবড়ালে চলবে না। আমাকে সব বলতে হবে স্কুলের কথা।মন খারাপের কথা। স—— ব।
সঞ্চালক– পরবর্তী কর্মসূচি এখুনি জানানো হবে। এখন পাঁচ মিনিটের টিফিন ব্রেক নেব। তারপর আবার অনুষ্ঠান শুরু হবে।
স্যার– আবার ব্রেক!
একে দেরি হয়ে যাচ্ছে। কী যে করে এরা? বুঝি না। আমার যে আর তর সইছে না।
সঞ্চালক—- আবার শুরু হচ্ছে অনুষ্ঠান। এখন আবৃত্তি করবেন– স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা।
এছাড়া শিক্ষক – আরোহন বন্দোপাধ্যায়।
স্যার– আর কত দেরী হবে? বুঝতে পারছি না। বেলা হয়ে যাচ্ছে।
সঞ্চালক– এবার পরপর ডাকা হচ্ছে বিদায়ী শিক্ষক মহাশয়দের। প্রত্যেকের নাম ঘোষণা করছি। আপনারা প্রস্তুত থাকুন।
স্যার– এই তো ঘোষণা হয়েছে। এবার আমার পালা। ঠিক বলতে পারব তো বলতে? চোখের পাতা মোটা হয়ে আসছে কেন? এরা তো সবাই আমার চেনা। তবু কেন এত কান্না পাচ্ছে?
সঞ্চালক– প্রথমে ডেকে নেব মানপত্রের লেখাটি পাঠ করতে শিক্ষিকা নাজিমা খাতুন মহাশয়াকে।
তারপর আরও একটা সমবেত সংগীত। তারপর চলে আসবেন পরপর।
স্যার– হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। বেলা ৩ টে বাজে।
দেখি কখন ডাকে আমায়?
সঞ্চালক — দুঃখিত। সময় আর বেশি হাতে নেই। এবার বিদায়ী শিক্ষকদের উপহার ও বক্তব্য শুনবো আমরা। তারপরই অনুষ্ঠান শেষ করব।আপনারা একটু ধৈয্য ধরে বসুন। কেউ চলে যাবেন না। ওনাদের সম্মানিত করতে হবে। আপনাদের উপস্থিতিটা খুব দরকার।
স্যার– একি সবাই চলে যাচ্ছে কেন? একটু থাকুন সবাই। আমার বক্তব্য আপনারা না শুনেই চলে যাবেন।
সঞ্চালক– মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি বিদায়ী স্যার — মনোতোষ মন্ডল মহাশয়কে।
স্যারের কানে কানে — একটু ছোট করবেন বক্তৃতা। বুঝতে পারছেন সময় হয়ে যাচ্ছে। পরপর চলে আসুন সবাই।
পরবর্তী ও শেষ বিদায়ী শিক্ষক মহাশয় বিষ্টুপদ মল্লিক মহাশয়। আসুন স্যার স্টেজে আসুন।
স্যার– থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলেন। সবে মাত্র পকেট থেকে কাগজটা বের করে পড়তে যাবেন। সঞ্চালক কাছে এলেন।
সঞ্চালক– স্যার,কিছু মনে করবেন না। বুঝতে পারছেন তো। সময় খুব কম হাতে।
৪ টে বেজে গেছে। সবাই উঠে পড়ছে। আর সবার কাহিনি একই। এসব শুনলে সবাই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। তার চেয়ে মানপত্র আর উপহার তুলে দিই। কী বলেন স্যার?
স্যার — (অবাক হয়ে) আমি কিছু বলব না? কেউ শুনবে না আমার কথা? আমি যে এত লিখে আনলাম । কেউ শুনবে না?
বেশ। তাই হোক।
কি—চ্ছু বলব না।
সঞ্চালক — দুঃখিত স্যার। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখন স্যারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে মানপত্র সহ উপহার। স্যার খুব ভালো থাকুন। এভাবেই তো সবাইকে চলে যেতে হবে। দুঃখ পাবেন না। চলুন স্যার আপনাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিই।
স্যার– (মুচকি হেসে) থাক। আমি একাই যেতে পারব। এখনো বুড়ো হয় নি। তোমরা অনুষ্ঠান শেষ করো।
কাগজের টুকরো টা পকেটে গুজে নিয়ে হল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
স্যার — কাগজটা ছিঁড়ে ফেলি। কী আর হবে রেখে? কেউ শুনল না আমার কথা। গিন্নী ঠিকই বলেছিল,কথাটা শুনলেই ভালো হতো।
ছাত্রীরা—– স্যার স্যার ভালো আছেন? কত দিন পর দেখছি আপনাকে। আপনার কথা শুনবো বলে স্কুল ছুটি হতেই চলে এসেছি।
আমি ময়না, মনে আছে স্যার। দশবছর আগে আপনার কাছে পড়েছি। এখন হাইস্কুলে পড়ি। আমি আপনার সেই দুষ্টু ছাত্রী ময়না।
রাখি— আর আমি রাখি। এখন ক্লাস নাইনে পড়ি। চিনতে পারছেন স্যার।
স্যার– ও তাই তো।
চোখে তেমন দেখি না তো?
চোখটা আবছা হয়ে আসছে।তবু তোমাদের ঠিক মনে রেখেছি।
ময়না— কী করে দেখবেন স্যার? চোখে যে জল ভর্তি। কাঁদবেন না স্যার।
চলুন স্যার, ওখানে বসি।
আমরা শুনবো আপনার কথা। কাগজটা ছিঁড়বেন না স্যার।আমরা সব শুনবো। আপনি পড়ুন।
রাখি —- আমাদের পক্ষ থেকে আপনার প্রিয় বকুল ফুল। আমাদের বাগানে ফুটে ছিল শুধু আপনার জন্য।
পছন্দ হয়েছে স্যার?
রাখি— আর আমার আঁকা ছবি “রবীন্দ্রনাথ “আপনার জন্য। সারা রাত ধরে এঁকেছি। ভালো হয়েছে স্যার?
স্যার– (বুকে জড়িয়ে ধরে) খুব খুব পছন্দ হয়েছে। আজ বড্ড খুশিরে। তোরাই তো আমার সব কিছু। তোরাই আমার শ্রেষ্ঠ উপহার। আয় আমার বুকে আয়।